প্রচ্ছদ > ক্যারিয়ার > ব্যবসা পরিকল্পনা > দুধের বিকল্প সয়াদুধ
দুধের বিকল্প সয়াদুধ

দুধের বিকল্প সয়াদুধ

দেশে সর্বপ্রথম সয়াদুধ তৈরির ওপর গবেষণা শুরু হয় ২০০৮ সালে। দুধের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সয়াদুধ আবিষ্কার করে। যা দুধের সব গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রাখে। পশুপালন অনুষদের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মো. নুরুল ইসলাম এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। লিখেছেন মাহতাব হোসেন

দেশে বছরে দুধের চাহিদা এক কোটি ২৫ লাখ মেট্রিক টন। অথচ দেশীয়ভাবে বছরে উত্পাদন সম্ভব মাত্র ২.২১ লাখ মেট্রিক টন। ঘাটতি থাকে ৮২.৯০ শতাংশ! অথচ গবেষকরা জানাচ্ছেন, সুস্থ মানুষের প্রতিদিন ২৫০ মিলিলিটার দুধের প্রয়োজন। দেশে মানুষপ্রতি গড়ে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪২ মিলিলিটার!
বর্তমান বাজারে এক লিটার গরুর দুধের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সেখানে সয়াদুধ মাত্র ৮-১০ টাকায় প্রতি লিটার উৎপাদন করা যাবে। এমনকি দুধের সব উপাদানও থাকবে অক্ষুণ্ন। আদর্শ গরুর দুধে শতকরা ৮৭.৩ শতাংশ পানি, ৩.৮ শতাংশ প্রোটিন, ৩.৫ শতাংশ ফ্যাট, ৪.৫ শতাংশ সুগার ও বিভিন্ন অনুপাতে খনিজ ও ভিটামিন থাকা উচিত। উদ্ভাবিত সয়াদুধে প্রতি ১০০ গ্রামে ৮৯.০২ গ্রাম পানি, ৩.৬ গ্রাম প্রোটিন, ৩ গ্রাম ফ্যাট, ৩.৭৮ শতাংশ সুগার, ৬ গ্রাম খনিজ  ও প্রয়োজনীয় ভিটামিন পাওয়া যায়।

সয়া দুধ

সয়া দুধ

সয়াদুধের সম্ভাবনা
আমাদের দেশে টিনের কৌটায় ফ্রান্স থেকে ‘সয়ামিল’ আমদানি করা হয়। যেটা শিশুদের হজমের জন্য সহায়ক। এটা বহুলভাবে বাংলাদেশে ব্যবহূত হয়। আমাদের দেশে এখনো তেমনভাবে সয়াদুধের কারখানা গড়েও ওঠেনি। তবে খুব শিগগির দেশ এই দুধ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে এগিয়ে যাবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড়, ব্যক্তিগত কিংবা বিভিন্ন সংস্থার তত্ত্বাবধানে সয়াদুধ উৎপাদন শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে যশোরের শার্শা উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে সয়াদুধ উৎপাদন করা হচ্ছে। বান্দরবানের লামায় কোয়াটামম সয়াদুধ তৈরির কারখানা স্থাপন করেছে। ঢাকার অদূরে গাজীপুরে ছোট-বড় বেশ কিছু সয়াদুধের কারখানা গড়ে উঠেছে। তবে বর্তমানে এ প্রযুক্তিটি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করার ইচ্ছা থাকলেও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে আগ্রহীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন বলে জানান ড. নূরুল ইসলাম।

শুরুর প্রক্রিয়া
সয়া দুধ উৎপাদন দুভাবে করা সম্ভব। এক. মেশিন ক্রয় করে। সয়া দুধ উৎপাদনের জন্য মেশিন পাওয়া যায়। সয়াকে কাইয়ে রূপান্তর করার মেশিন এখনো দেশে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। জার্মানি থেকে অনেকে আমদানি করে। এই প্রক্রিয়ায় একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ দুধ উৎপাদন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শুরুতে পুঁজিটা বেশি লাগে।
দুই. হাতেও সয়াদুধ তৈরি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শিল-পাটা কিংবা সয়া গুঁড়ো করার ব্লেন্ডার মেশিন অথবা স্থানীয় পদ্ধতিতেও সম্ভব। সয়া গুঁড়ো করে এর কাই প্রতি লিটার পানিতে ভিজিয়ে ছেঁকে নিয়ে খুব সহজেই সয়াদুধ উৎপাদন করা হয়।

পুঁজি কেমন
সয়াদুধের ব্যবসা যেহেতু দুভাবে শুরু করা সম্ভব; সেহেতু ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েও ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। তবে ব্যবসা জোরালোভাবে শুরু করতে চাইলে প্রথমে ১৫ লাখ টাকা লাগবে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক মেশিনের দামটাই বেশি। মেশিনের দাম ১২ লাখ।

কাঁচামাল কোথায় পাওয়া যায়
সয়া কম-বেশি স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায়। তবে বীজ সংগ্রহ করে নিজেই চাষ করতে পারলে লাভ বেশি হবে। বাংলাদেশে সব ধরনের মাটিতে সয়াবিন চাষ করা যায়। এ ছাড়া

সয়া শস্য

সয়া শস্য

কুষ্টিয়া, যশোর অঞ্চলেও সয়ার আবাদ ভালো হয়। তবে পলি, দো-আঁশ মাটিতে সয়াবিন চাষ ভালো হয়। সয়াবিন চাষ গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতকালে করা যায়। যেমন বাংলাদেশে মধ্য ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সয়া চাষ করা যায়। এপ্রিলে মূলত সয়া ফসল ঘরে তোলা হয়। এ ছাড়া বীজের জন্য জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সয়া চাষ করা হয়। চাষের জন্য লাগে একরপ্রতি ১২ থেকে ১৬ কেজি বীজ। চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার সয়া ব্যবসায়ী মানিক মিয়া জানান, তিনি বছরের সবসময়ই দেশের অনেক জায়গায় সয়া সরবরাহ করে থাকেন।

সয়া দুধ দিয়ে আর কী হয়
গরুর দুধের মতো সয়াদুধ দিয়েও সৌখিন সব ধরনের খাদ্য তৈরি করা যায়। চায়ের মধ্যে গরুর দুধের পরিবর্তে অনায়াসেই সয়াদুধ ব্যবহার করা যাবে। স্থানীয় পদ্ধতিতে এই দুধ তৈরি করে তা দিয়ে দই বানিয়েছেন ঝিকরগাছা উপজেলার লাউজানী গ্রামের ডা. সাইদুল ইসলাম। তিনি জানান, গরুর দুধের দই বানানোর নিয়মেই সয়াদুধ দিয়ে দই বানিয়েছেন। স্বাদে ও বর্ণে কোনো পার্থক্য নেই। শুধু তাই নয়, এ সয়াদুধ দিয়ে দই, রসগোল্লা, রসমালাইও তৈরি করা সম্ভব। গরুর দুধের সন্দেশ ও সয়া সন্দেশের মধ্যে কোনো তফাত নেই।
টেক্সাস উইমেনস ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেস হাইটন সেন্টারের ডাক্তার জন যার্ডেলিফ ইন্টারনেট স্বাস্থ্যবার্তায় বলেছেন, যারা নিরামিষভোগী বা গরুর দুধে যাদের অ্যালার্জি আছে, তারা সয়াদুধ খেতে পারে। এর স্বাদ ভালো। হাড় গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ এই দুধে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও সয়া ডায়াবেটিক রোগীদের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথষ্টে সহায়তা করে।
ক্রেতা কারা
ক্রেতা করা হবে, তা আপনার ওপর নির্ভর করবে। প্রথমে স্থানীয়ভাবে প্রচারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এরপর স্থানীয় বাজারের দোকানে প্রচার চালাতে হবে। এখন দেশের বেশ কিছু এলাকায় সয়াদুধ তৈরি হচ্ছে। দিন দিন এর চাহিদা বেড়ে চলেছে। হাটবাজারের রেঁস্তোরায় পাইকারিভাবে সয়াদুধ সরবরাহ করে আসছে অনেকেই।

আয় কেমন
৩৪ লিটার দুধ তৈরিতে সয়াবিন লাগে চার কেজি। প্রতি কেজি সয়াবিনের দাম সর্বোচ্চ ৮০ টাকা হিসেবে চার কেজি সয়াবিনের দাম ৩২০ টাকা। মেশিনে উৎপাদিত সয়াদুধ নিজেদের দোকান থেকেই ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়। যেখানে গরুর দুধের কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। শুরুতে মাসে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। ব্যবসার প্রসারের সঙ্গে বাড়বে আয়। গাজীপুরের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার রেঁস্তোরা ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম স্বপন জানান, তিনি তার দোকানে পরীক্ষামূলক সয়াদুধের মিষ্টি তৈরি শুরু করেছিলেন। প্রথমে গ্রাহকদের বলেই বিক্রি করেন। এখন তিনি মিষ্টির পাশাপাশি চায়েও সয়াদুধ ব্যবহার করেন। এটা গরুর দুধের চেয়ে সাশ্রয়ী। গ্রাহকরাও সানন্দে গ্রহণ করছেন।
গাজীপুরের অল্প কয়েক জায়গায় এই দুধ উৎপাদন হয়। তিসি গিয়ে নিয়ে আসেন, আবার উৎপাদকরাও মাঝেমধ্যে দোকানে দিয়ে যান। একই কথা জানালেন যশোরের এক স্কুল শিক্ষক মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাড়ির দুধের চাহিদা গরুর দুধের পরিবর্তে সয়াদুধ দিয়েই পূরণ করছি।’

ভালো করতে চাইলে
যশোরের শার্শা উপজেলায় জাপান-বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন সয়াদুধের বাণিজ্যিক উত্পাদন শুরু করেছে। এটা এই সংস্থার অধীনে ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন মিলে এর উত্পাদন শুরু করেন। এই সংস্থাটির একজন মহাদেব চন্দ্র বসু। তিনি জানান, এই ব্যবসা শুরু করতে চাইলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সয়াদুধ কী- বিষয়টা মানুষকে বোঝাতে হবে। বাজারে চাহিদা তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা সয়াদুধ উৎপাদন করে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছি। এর জন্য আমাদের প্রচার চালাতে হয়েছে। এই এলাকায় এখন মানুষ সয়াদুধের উপকারিতা বোঝে।

 

Comments

comments

Comments are closed.