প্রচ্ছদ > শিক্ষা > ফিচার > ৫ কোটি শিক্ষার্থীর বিকল্প পাঠদান
৫ কোটি শিক্ষার্থীর বিকল্প পাঠদান

৫ কোটি শিক্ষার্থীর বিকল্প পাঠদান

আরাফাত শাহরিয়ার :::

প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা। সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এই ছুটিতে বাইরে যাওয়াও বারণ! ফলত ঘরবন্দি শিক্ষার্থীরা। কয়েক দফা বেড়ে ছুটি ছুঁয়েছে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কবে নাগাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে, বলতে পারছেন না কেউই। ঈদুল ফিতরের আগে আর খুলছে না এটা অনেকটাই নিশ্চিত। এলেমেলো দেশের ৫ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাসূচি। পিছিয়ে পড়ছে ছাত্রছাত্রীরা। রয়েছে সেশনজটের আশঙ্কা। করোনা ভাইরাস তামাম বিশ্বকে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার মুখে! এ সময়টায় শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
দুনিয়াজুড়ে মানুষকে বিচ্ছিন্ন আর ঘরবন্দী করেছে যে করোনা ভাইরাস, সেটি প্রথম ছড়িয়ে পড়ে চীনে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলেও দেশটিতে লেখাপড়া এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। অনলাইনে নিয়মিত চলছে পাঠদান। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে অনলাইনে পাঠদান খানিকটা দুরূহ। তৃণমূল পর্যায়ে ইন্টারনেটের অপ্রতুলতা ও কচ্ছপ গতি এতে বড় অন্তরায়। আমাদের টিভি সম্প্রচারই ভরসা। এরই মধ্যে চমৎকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচারের উদ্যোগ।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উদ্যোগে সংসদ টেলিভিশনে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ নামে শ্রেণিভিত্তিক ক্লাস কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২৯ মার্চ থেকে প্রতিদিন ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ের ৮টি ক্লাস প্রচারিত হচ্ছে। সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে এসব ক্লাস। পুনঃপ্রচার করা হয় দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। ক্লাসের শেষের দিকে দেওয়া হয় বাড়ির কাজ। ওই হোমওয়ার্কের ভিত্তিতে স্কুল খোলার পর শিক্ষক নম্বর দেবেন।
প্রতিটি ক্লাস ১৫ থেকে ২০ মিনিট ব্যাপ্তির, যা যথেষ্ট নয়। এর ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ৪০ মিনিট করা দরকার। রেকর্ড করা এসব বিষয়ভিত্তিক লেকচার আপলোড করার কথা ইউটিউব ও কিশোর বাতায়নের ওয়েবসাইটে (www.konnect.edu.bd)। ইউটিউবে সব লেকচার মিলছে না। ওয়েবসাইটটিকে সচল ও হালনাগাদ রাখতে হবে। ওয়েবসাইট ও ইউটিউবে প্রতিদিন সব লেকচার আপলোড করতে হবে।
আগামী ৩ মাসের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে সরকারের এটুআই প্রকল্পের সহযোগিতায় শ্রেণিভিত্তিক ক্লাস কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিটিভি বেশি জনপ্রিয় ও সহজলভ্য। সংসদ টেলিভিশনের পাশাপাশি বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে সম্প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হলে আরও বেশি ফলপ্রসু হতো। দেশের বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোকেও কীভাবে এর সঙ্গে যুক্ত করা যায়, সেটি নিয়েও ভাবতে হবে। বাংলাদেশ বেতার ও এফএম রেডিওতেও এর সম্প্রচার করা যেতে পারে।
এ বিশেষ কার্যক্রম সারা দেশের শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারে সেরা স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের পাঠ। তবে সেটি কার্যকরী যেন হয়, সেদিকে খেয়াল রাখাটা জরুরি। ক্লাস লেকচার পরবর্তী সময়ে ছাত্র ও শ্রেণি শিক্ষকদের মধ্যে যোগাযোগ থাকতে হবে। শিক্ষকরা ঘরে বসেই অনলাইনে শিক্ষার্থীদের দরকারি নির্দেশনা দেবেন। ছাত্রছাত্রীরাও কোনো বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে জেনে নেবে। মোবাইল অপারেটররা এ সময়টাতে অন্তত ৫০ জিবি করে ইন্টারনেট বিনামূল্যে দিতে পারে। অনেকের হাতে হাতে স্মার্টফোন। স্মার্টফোনে অনুষ্ঠান লাইভ দেখা গেলে বা ডাউনলোড করে দেখতে পারলে সুফল মিলবে।
লেকচারের ভিডিওচিত্র ধারণ করে দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে। শিক্ষামূলক এ অনুষ্ঠান বা পাঠদান কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা যেতে পারে। এটি আরো বেশি কার্যকরী হবে। এতে অনুষ্ঠান চলাকালে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে টিভি দর্শক-শিক্ষার্থীরা। এতে কোনো বিষয় না বুঝলে প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারবে শিক্ষার্থীরা। ইউটিউব ও ওয়েবসাইটে লেকচারের নিচে কমেন্টের মাধ্যমে যাতে প্রশ্ন করতে পারে ছাত্রছাত্রীরাÑএ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
দূরশিক্ষণ কার্যক্রম থেকে শিখতে পারবে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকÑসবাই। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এ অনুষ্ঠান দেখে নতুন অনেক কিছু শেখার সুযোগ পাবে। ঢাকা ও গ্রামের পাঠদান পদ্ধতিতে বিস্তর ফারাক। মানসম্মত স্কুলে ক্লাসের উপস্থাপনা ও ভাষা প্রয়োগের বিষয়টি থেকে গ্রামের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শেখার সুযোগ পাবে। শিক্ষকরা এ অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের শিক্ষাদান পদ্ধতি মিলিয়ে দেখতে পারবেন। এতে দুর্বল শিক্ষকরা অনেক কিছু শিখতে পারবে ও উন্নত পাঠদান কৌশল রপ্ত করতে পারবে। এ অনুষ্ঠানটি অভিভাবকদেরও অনেক কাজে আসবে। যেসব অভিভাবক শিশুদের পড়াশোনায় সাহায্য করেন, তারা এ অনুষ্ঠান দেখে নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারবেন অনেক কিছু।
এ কার্যক্রমের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করছে যে শিক্ষক ক্লাসটি নেবেন তাঁর ওপর। শিক্ষক ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে লেকচার দেন, এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তালিকায় এমন শিক্ষকদেরই রাখতে হবে, যাঁরা ক্লাসে ভালোভাবে বুঝাতে পারেন, উচ্চারণ শুদ্ধ ও স্পষ্ট। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ভালো মানের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের এর আওতায় আনতে হবে। পাঠদান পদ্ধতি মজাদার, আকর্ষণীয় না হলে উদ্দেশ্য সফল হবে না।
টিভিতে পাঠদান কার্যক্রমের আরও বেশি প্রচারণা চালাতে হবে। বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, সংসদ টিভি ছাড়াও স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত বিরতিতে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে। সংবাদপত্রে এ অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে হবে। সব মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে সব মুঠোফোনে এ সংক্রান্ত খুদেবার্তা পাঠাতে হবে। তবেই টেলিভিশনে প্রচারিত ক্লাস ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকÑসবার দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে ও সাড়া ফেলবে। এর সুফল পাবে সারাদেশের ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে গিয়ে পাঠ নেওয়ার সুযোগ যেহেতু নেই, দূরশিক্ষণই চমৎকার সমাধান। বিষয়টি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নতুন নয়। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে পাঠদান করে আসছে। এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ টেলিভিশনেরও আছে। বিটিভিতে সেরা স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের পাঠদান সম্প্রচার শুরু করা হয়েছিল ২০১১ সালের ১৪ জুন থেকে। দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সেরা শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক পাঠদান ধারণ করে প্রচার করা হতো। গ্রাম বা মফস্বলের ছেলেমেয়েরা যাতে সেরা সেরা স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের পাঠ ঘরে বসেই গ্রহণ করতে পারে, এমনটিই ছিল উদ্দেশ্য। সেময় প্রচারের জন্য অনেক স্কুলের শিক্ষকদের ক্লাসের ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয়েছিল। এসব ভিডিওচিত্র স্বাভাবিকভাবেই বিটিভির আর্কাইভে থাকার কথা। এসব লেকচারও পুনরায় সম্প্রচার শুরু করা যেতে পারে।
অবরুদ্ধ দিনগুলোতে টিভিতে পাঠদান যেন করা হয় খেলার ছলে। তাই লেকচার আনন্দদায়ক, মজার করে তোলার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। পড়ার ফাঁকে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষামূলক বিজ্ঞাপন প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আদবকেতা, নীতি-নৈতিকতা, পরিবেশ সচেতনতা, দেশপ্রেম প্রভৃতি শেখাতে হবে। সেটা হতে পারে গল্পের ছলে, কার্টুনের মাধ্যমে।
অনেক গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা অন্য কোনো কারণেও অনেকে অনুষ্ঠান দেখতে পারবে না, এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সম্প্রচারিত ভিডিওচিত্র সিডি বা ডিভিডি ফরম্যাটে সরবরাহ করা যেতে পারে। বিদ্যুতবিহীন গ্রাম, প্রত্যন্ত অঞ্চল ও মফস্বল শহরে এ কাজটি করতে হবে বিনামূল্যে। ইউটিউবে দিনের ভিডিওচিত্র দিনেই দিতে হবে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ বেশ জনপ্রিয়। এসব ভিডিওচিত্র এতে দিলেও ফল পাওয়া যাবে। ফেসবুকে এর জন্য একটি পাবলিক পেইজ খোলা যেতে পারে। শ্রেণিভিত্তিক ক্লাস কার্যক্রমের জন্য ফ্রি ফেসবুক, ফ্রি ইউটিউব, ফ্রি ওয়েবসাইটÑকীভাবে করে দেওয়া যায়, ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে বসে ঠিক করতে হবে।
দেশের বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম চলছে। অনলাইনে কুইজ, ক্লাস টেস্ট ও অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেওয়া হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম চালু করতে হবে। একজন শিক্ষক চাইলে অনলাইনে ক্লাস নিতে পারেন। জুম ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপের মাধ্যমে অন্তত ১০০ জন শিক্ষার্থীর ভিডিও ক্লাস করা সম্ভব। গুগল ক্লাসরুম অ্যাপও বেশ কার্যকরী। ই-লার্নিং বা দূরশিক্ষণ হতে পারে সমাধান। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী বেশ প্রচলিত ও জনপ্রিয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলেই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে।
প্রাথমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী। এ পর্যায়ের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদেরও দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। আশাবাদের খবর এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কথাও ভাবতে হবে। টিভিতে পাঠদান কার্যক্রমের আওতায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আনা সময়ের দাবি। দেশের অধিকাংশ স্কুল ভালো মানের শিক্ষক পাচ্ছে না। তাই মানসম্মত স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাস সম্প্রচার হতে পারে একটি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। চাইলে সারাবছরও এ কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। এর জন্য একটি শিক্ষা টিভিও চালু করা যেতে পারে। একটি শিক্ষামূলক টিভি চ্যানেল পরিচালনা খুব বেশি কঠিন হবে না আমাদের দেশের জন্য।

# আরাফাত শাহরিয়ার : শিক্ষা ও ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞ। সহকারী পরিচালক, ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: arafat.shahriar@gmail.com

.

Comments

comments

Comments are closed.