আশরাফ-উল-আলম :::
২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার পোস্তগোলার ইস্টার্ন হাউজিং প্রকল্পের একটি বাসায় খুন হন ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর আলম হত্যা মামলার বিচার চলছে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এর আদালতে। এ মামলায় আটক খলিল, লিটনসহ চার আসামির কোনো আইনজীবী নেই। আইনজীবী দিয়ে মামলা পরিচালনার জন্য আর্থিক সামর্থ্য তাঁদের নেই। আর তাই তাঁদের আইনগত সহায়তা দিচ্ছে সরকার। ঢাকা জেলা আইনগত সহায়তা কমিটির আইনজীবী রায়হান মোর্শেদ তাঁদের পক্ষে এখন আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
কেরানীগঞ্জের আঁখিরও মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আর্থিক সামর্থ্য নেই। তিনি আইনগত সহায়তা চান। ঢাকা জেলা আইনগত সহায়তা কমিটি তাঁকে আইনগত সহায়তা দিচ্ছে।
আর্থিকভাবে অসচ্ছল, দরিদ্র ও অসহায়; কিন্তু অধিকার আদায়ের জন্য মামলা করা বা মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রয়োজন_এমন ব্যক্তিদের আইনগত সহায়তা দেয় সরকার। সরকারি খরচেই তাদের মামলা পরিচালনা করার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় গঠন করা হয়েছে আইনগত সহায়তা কমিটি। অসচ্ছল, দরিদ্র ও অসহায় যাঁরা মামলা পরিচালনা করতে সক্ষম নন, তাঁরা এই কমিটির কাছে আইনগত সহায়তা চেয়ে নির্ধারিত ফরমে আবেদন জানালে কমিটি সরকারি খরচে তাঁদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে দেবে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল, দরিদ্র ও অসহায়দের আইনগত সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার ২০০০ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন প্রণয়ন করেছে। ওই আইনের আওতায় আইনগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের আইনগত সহায়তা দেওয়ার বিষয়টির ব্যাপক প্রচার না থাকায় আইনগত সহায়তা চেয়ে জেলা আইনগত সহায়তা কমিটির কাছে আবেদনের সংখ্যা খুব কম।
গত মঙ্গলবার ঢাকা জেলা আইনগত সহায়তা কমিটি ঢাকার কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। ওই সভায় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কৃষ্ণা দেবনাথ সভাপতিত্ব করেন। সভায় জানানো হয়, ২০০৭ সালে মাত্র ৫২৪ জন অসচ্ছল ব্যক্তি আইনগত সহায়তা নিয়েছেন। এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসেই ৫২৪ জন আইনগত সহায়তা নেওয়ার জন্য কমিটির কাছে আবেদন করেছেন। ঢাকার আদালতে ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার মামলায় আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ছাড়া অন্যান্য জেলায় এ সহায়তা পাওয়ার চিত্র আরো করুণ। জেলা জজ জানান, আইনগত সহায়তা নেওয়ার হার আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে ঢাকার জনসংখ্যার তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। তিনি মনে করেন, ঢাকার মোট জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশ বস্তিতে বসবাস করে। তাদের মধ্যে অনেকেই মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। অনেকেরই মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার আর্থিক সামর্থ্য নেই। কিন্তু আইনগত সহায়তার বিষয়টি সম্পর্কে না জানার কারণে এখানে আবেদনকারীর সংখ্যা কম। তিনি জানান, প্রতিবছরই আইনগত সহায়তার জন্য যে অর্থ কমিটিকে দেওয়া হয় তার বেশির ভাগই ফেরত চলে যায়। তিনি আরো জানান, গরিবদের আইনগত সহায়তা দিতে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছে কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (সিডা)।
যারা আইনগত সহায়তা পাবে
আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন ও নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচারপ্রাপ্তিতে অসমর্থরা আইনগত সহায়তা পাবেন। কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন বা বার্ষিক ছয় হাজার টাকার ওপরে আয় করতে অক্ষম ব্যক্তি, বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন কোনো ব্যক্তি, দুস্থ মা, পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশু, এসিডদগ্ধ নারী ও শিশু, আদর্শ গ্রামে বসবাসরত ব্যক্তি, অসচ্ছল বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্ত বা দুস্থ মহিলা, উপার্জনে অক্ষম বা সহায়-সম্বলহীন প্রতিবন্ধী, বিনা বিচারে কারাগারে রয়েছেন, হয়রানির শিকার হয়ে কারাগারে আছেন, কোনো কারণে বিচার বিলম্বিত হচ্ছে অথচ আসামিকে কারাগারে দিন কাটাতে হচ্ছে, স্বামী পরিত্যক্ত অথচ অধিকার আদায়ের জন্য মামলা করার আর্থিক সামর্থ্য নেই, নিজের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন অথচ মামলা করার আর্থিক সামর্থ্য নেই_এমন সব ব্যক্তি, মহিলা ও শিশুদের আইনগত সহায়তা দেয় সরকার।
কিভাবে কার কাছে আবেদন করতে হবে
আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য প্রতিটি জেলার জেলা আইনগত সহায়তা কমিটির কাছে আবেদন জানানো যাবে। দেশের ৬৪ জেলায় আইন সহায়তা কমিটির কার্যালয় গঠন করার বিধান থাকলেও অধিকাংশ জেলায় এ কার্যালয় নেই। জেলা জজের কাছে আইনি সহায়তার জন্য আবেদন করতে হবে। আবেদন গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট কর্মকর্তা রয়েছেন। তবে ঢাকায় জেলা জজ আদালতের নতুন ভবনের নিচতলায় ঢাকা জেলা আইনগত সহায়তা কমিটির কার্যালয় রয়েছে। ওই কার্যালয়ে আইনি সহায়তার জন্য সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অ্যাডভোকেট শাকিল আহমেদ। ঢাকায় যাঁরা বিনা মূল্যে আইনগত সহায়তা নিতে চান, তাঁরা কমিটির কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন করতে পারবেন। কোনো আসামি কারাগারে থাকলে তাঁর স্বজনরা এ আবেদন করতে পারবেন। অথবা আদালতের অনুমতি নিয়ে আটক আসামি নিজেই আবেদন জানাতে পারবেন।
প্রতিটি জেলার আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক, জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা বা কারাকর্তৃপক্ষের কাছে বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য আবেদন করা যাবে।
কোনো টাকা-পয়সার দরকার নেই
আইনগত সহায়তা পেতে আবেদন জানাতে কোনো টাকা-পয়সার দরকার নেই। আইনগত সহায়তা কমিটি সরকারি খরচে আবেদনকারীর জন্য আইনজীবী নিয়োগ করবে। তারাই মামলা পরিচালনা করবেন। মামলা পরিচালনার জন্য কোনো আইনজীবীকেও টাকা-পয়সা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ঢাকা জেলায় ১৬৮ জন আইনজীবীর একটি প্যানেল রয়েছে। তাঁরা আইনগত সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।