গর্ভকালীন বিপদ-আপদ

গর্ভকালীন বিপদ-আপদ

দেশে গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত জটিলতায় প্রতিদিন ৩২ জন নারী মারা যান। মৃত্যু ঘটে বহু শিশুর। অথচ কিছু বিষয় জানা থাকলে এড়ানো যায় এই বিপদগুলো। লিখেছেন ইবনে সিনা হাসপাতাল, ঢাকার কনসালটেন্ট ডা. মুসাররাত সুলতানা ও ২০০ শয্যাবিশষ্টি হাসপাতাল নারায়ণগঞ্জের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. উম্মে তাহমিনা সীমা

বাংলাদেশে মোট প্রসবের ৭৭ শতাংশ বাড়িতে হয়, ২৩ শতাংশ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে হয়। মোট প্রসবের মাত্র ২৬ শতাংশ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীর মাধ্যমে হয়। অধিকাংশ গর্ভবতী মা প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান না। অথচ মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমাতে নিয়মিত গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি।

ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভ
কিছু ক্ষেত্রে গর্ভধারণের সময়ই ঝুঁকির কথা জানা যায়। সেসব ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা ও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। এগুলো হলো-
বয়স : গর্ভবতী মহিলার বয়স ২০ বছরের কম অথবা ৩০ বছরের বেশি হলে বিপদের ঝুঁকি বেশি। কারণ ২০ বছরের কম বয়সী নারীদের শ্রোণীচক্র বা পেলভিস সন্তান ধারণোপযোগী হয় না, আর পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব নারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি জটিলতা বেশি হয়।
সন্তান সংখ্যা : সন্তান সংখ্যা পাঁচ বা তার অধিক হলে পরবর্তী গর্ভকালীন মায়ের জরায়ু ফেটে যাওয়া, জরায়ু বের হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া মায়ের অপুষ্টি (অতিরিক্ত গর্ভধারণজনিত) গর্ভকালীন ঝুঁকির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়।
পূর্ববর্তী সন্তান জন্মের ব্যবধান : দুই সন্তানের বয়সের ব্যবধান দুই বছরের কম হলে মায়ের অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। তা ছাড়া সময়ের ব্যবধান কম থাকার কারণে উভয় শিশুই মায়ের বুকের দুধ কম পায়, মায়ের পক্ষেও স্বাস্থ্যগত কারণে যথাযথ যত্ন নেওয়া সম্ভব হয় না।
মায়ের উচ্চতা : ৪ ফুট ১০ ইঞ্চির কম উচ্চতাসম্পন্ন নারীদের ক্ষেত্রে শ্রোণীচক্রের আকৃতি ছোট হওয়ায় প্রসবকালীন জটিলতা বাড়ে।
অতীত গর্ভকালীন ইতিহাস : আগের সন্তান ধারণকালে বা প্রসব-পরবর্তী যদি নিম্নলিখিত জটিলতা পরিলক্ষিত হয়, তবে তা বাড়তি ঝুঁকির কারণ বলে বিবেচনা করা হয়। যেমন- প্রসব-পূর্ব অথবা প্রসব-পরবর্তী রক্তপাত,  একলামশিয়া বা খিঁচুনি, দীর্ঘায়িত প্রসব (১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে প্রসব বেদনা হওয়া),  বাধাগ্রস্ত প্রসব (জরায়ুর সংকোচন হওয়া সত্ত্বেও প্রসব সম্ভব না হওয়া), অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব করানো যেমন : সিজারিয়ান অপারেশন,  জরায়ুর ভেতর গর্ভফুল থেকে যাওয়া, মৃত সন্তান প্রসব করা।
গর্ভকালীন জটিলতা
নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো গর্ভকালীন জটিলতার নির্দেশ করে। তাই এ ধরনের লক্ষণ দেখা মাত্র চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া কর্তব্য।
রক্তস্বল্পতা (হাতের তালু, চোখের পাতা খুব ফ্যাকাসে হওয়া)
# পা ফোলা (গর্ভকালীন পায়ে পানি আসা অনেক সময় স্বাভাবিক, যা বিশ্রাম নিলে বা শোয়ার সময় পায়ের নিচে বালিশ রাখলে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু যদি বিশ্রামের পরও পানি না কমে এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি থাকে, তবে তা গর্ভকালীন জটিলতা সৃষ্টি করে)।
# গর্ভকালীন যেকোনো সময় প্রসবের রাস্তা থেকে রক্তপাত হওয়া।
# যেকোনো কারণে শ্বাসকষ্ট হওয়া।
# পেটের আকার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া।
# উচ্চ রক্তচাপ (১৪০/৯০ মিলিমিটার পারদের বেশি হওয়া)।

গর্ভকালীন পাঁচটি বিপজ্জনক লক্ষণ
কিছু কারণ আছে, যা দেখা দেওয়ামাত্র গর্ভবতী নারীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে আছে যোনিপথে রক্তপাত, তীব্র মাথাব্যথা ও তার সঙ্গে চোখে ঝাপসা দেখা, হঠাৎ অধিক জ্বর,  দীর্ঘায়িত প্রসব বেদনা, যেকোনো ধরনের খিঁচুনি।

প্রসবকালীন জরুরি অবস্থা
শুধু গর্ভকালেই নয়, প্রসবের সময়ও বেশ কিছু জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন-
প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তপাত : প্রসবের পর থেকে পরবর্তী ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত যেকোনো সময় অতিরিক্ত রক্তপাত (৫০০ মিলির বেশি) বিপজ্জনক। এটি সাধারণত প্রসব-পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেশি হয়, তবে পরবর্তী ছয় সপ্তাহের মধ্যেও হতে পারে। সাধারণত অধিক সন্তান জন্মদানকারী মা, দীর্ঘায়িত প্রসব বেদনা, গর্ভে পানি বেশি থাকা, গর্ভে যমজ শিশু ধারণ করা, প্রসব-পূর্ববর্তী রক্তপাত হওয়ার ইতিহাস থাকা, অজ্ঞানকারী ওষুধ হিসাবে ব্যবহূত হ্যালোথেনের প্রভাবে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে, ক্রস-ম্যাচিং করে প্রয়োজনীয় রক্ত দিতে হবে এবং যথাযথ কারণ অনুসন্ধান করে সে অনুযায়ী চিকিত্সা নিতে হবে।
একলামশিয়া : গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পরে যেসব রোগীর উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয় অথবা আগে থেকেই যারা উচ্চ রক্তচাপের রোগী তাদের ক্ষেত্রে একলামশিয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। পূর্ব লক্ষণ হিসেবে গর্ভবতী নারীর উচ্চ রক্তচাপ, মুখ, হাত ও পায়ে প্রচুর পানি আসা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, তীব্র মাথাব্যথা ও সঙ্গে ঝাপসা দেখা, পেটের ওপরের দিকে ব্যথা অনুভূত হওয়া ইত্যাদি দেখা যায়।
পূর্ব লক্ষণযুক্ত প্রসূতি মাকে যথাশিগগির সম্ভব বিশেষায়িত হাসপাতালে প্রেরণ করা জরুরি। অন্যথায় গর্ভবতী মায়ের মসি্তষ্কে রক্তপাত, হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু, শ্বাসতন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া কিংবা গর্ভের শিশুর মৃত্যু হতে পারে।
গর্ভকালীন শেষ তৃতীয় ভাগে রক্ত যাওয়া : গর্ভধারণের ২৮ সপ্তাহ পর থেকে প্রসবের সময় পর্যন্ত যোনিপথে রক্ত যাওয়া বিপদের লক্ষণ। এ সময় সাধারণত গর্ভফুল নিচের দিকে থাকা, উচ্চ রক্তচাপ, দুর্ঘটনা, গর্ভে পানি বেশি থাকা, গর্ভে যমজ সন্তান থাকার কারণে রক্তপাত হতে পারে। এ ধরনের লক্ষণ থাকলে অবশ্যই দ্রুত রোগীকে বিশেষায়িত হাসপাতালে নিতে হবে।
প্রসবকালে শিশুর কাঁধ আটকে যাওয়া : কিছু কারণে প্রসবের সময় শিশুর মাথা বের হওয়ার পরও কাঁধ আটকে যেতে পারে। কারণগুলোর মধ্যে আছে মায়ের ডায়াবেটিস ও স্থূলতা, বড় আকৃতির শিশু, অ্যানেনকেফালি (শিশুর জন্মগত ত্রুটি, যেখানে শিশুর মাথার খুলি থাকে না), শিশুর নাভিরজ্জু ছোট থাকা, মায়ের সংকুচিত যোনিদেশ ।
এসব ক্ষেত্রে প্রসবের আগেই আলট্রাসনোগ্রাম ও অন্যান্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য ঝুঁকি নির্ণয় করা যায় ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর প্রসব করিয়ে জটিলতা এড়ানো যায়। তাই গর্ভকালীন নিয়মিত চিকিত্সকের তত্ত্বাবধানে থাকা খুব জরুরি।
আর প্রসবকালে এ ধরনের সমস্যা হওয়া মাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালে যেতে হবে। অন্যথায় মা ও শিশু উভয়ের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, শিশুর হাত ও কাঁধ ভেঙে যেতে পারে।
বাধাগ্রস্ত প্রসব : জরায়ুর শক্তিশালী সংকোচন সত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রে প্রসব সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে প্রসব বেদনা হয়; কিন্তু সন্তান জন্ম নিতে পারে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সামান্য সময়টুকুও নষ্ট না করে মাকে শিগগির বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসার মাধ্যমে বাধগ্রস্ত প্রসবের জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

গর্ভকালীন সেবা
গর্ভকালীন এবং প্রসবকালীন জটিলতা এড়ানোর জন্য একজন প্রসূতি মা নিকটস্থ হাসপাতাল অথবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গর্ভকালীন কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করবেন। এগুলো হলো-
# ১২-১৬ সপ্তাহের মধ্যে একবার
# ২৪-২৮ সপ্তাহের মধ্যে একবার
# ৩২ সপ্তাহের মধ্যে একবার এবং
# ৩৬ সপ্তাহে একবার।

প্রসূতি মায়ের জন্য কিছু পরামর্শ  
# প্রসূতি মা স্বাভাবিক খাবারের বাইরেও প্রতিদিন অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করবেন।
# মাছ, মাংস, ডিম, দুধ জাতীয় প্রাণিজ আমিষ নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে।
# স্থূল মায়েদের জন্য শর্করাজাতীয় খাবার (ভাত, রুটি) কিছুটা কম গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
# গর্ভবতী মাকে প্রচুর পানি পান করাতে হবে, যাতে প্রস্রাবে ইনফেকশন না হয়।
# সবুজ শাক, হলুদ ফল প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে।
# মা স্বাভাবিক কাজকর্ম করবেন, তবে পরিশ্রমসাধ্য কাজ না করা ভালো।
# গর্ভবতী মা প্রতিদিন দুপুরে দুই ঘণ্টা এবং রাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুমাবেন।
# হালকা ব্যায়াম করা যেতে পারে। ব্যায়ামের বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন আগে।
# গর্ভধারণের প্রথম ও তৃতীয় ভাগে সহবাস না করা এবং মধ্যভাগে সাবধানতার সঙ্গে সহবাস করা যেতে পারে। গর্ভপাতের ইতিহাস যেসব মায়ের থাকে তাদের ক্ষেত্রে সহবাস এড়ানো বাঞ্ছনীয়।
# প্রথম ও শেষ ভাগে উড়োজাহাজ বা এমন কোনো যানে ভ্রমণ না করা, যেখানে ঝুঁকির পরিমাণ বেশি হয়।
# ধূমপান, মদ্যপান বা কোনো নেশা না করা।
# ধনুষ্টংকারের টিকা নিতে হবে।
# প্রতিদিন গোসল করা এবং ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করা।
# ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন না করা।
# প্রসব নরমাল বা সিজারিয়ান যা-ই হোক বাড়ির পরিবর্তে হাসপাতালে করানোর ব্যবস্থা করা।

সূত্র : ডাক্তার আছেন, কালের কণ্ঠ

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*