হয়তো মনের আনন্দে মাছ ভাজছিলেন। হঠাৎ গরম তেলের ছিটা এসে লাগল চোখে-মুখে-হাতে। অথবা ফুটফুটে সোনামণি দুরন্ত ছোটাছুটির মাঝে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলো টেবিলের কোনায়। বয়ে গেলো রক্তের বন্যা। কিংবা বাথরুমে পা পিছলে ভেঙে গেলো শরীরের কোনো অংশ। এমন সব বিপদের সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় না হয়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সামলানো যায় ছোটখাটো মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি। বিজ্ঞানসম্মতভাবে ফার্স্ব এইড বা প্রাথমিক চিকিৎসা করতে পারলে বহুক্ষেত্রে জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়। লিখেছেন ইমার্জেন্সি বিশেষজ্ঞ ডা. অমিত আহসান
ঘরবাড়িতে সাধারণ দুর্ঘটনা
ঘরের মধ্যে ছোটখাটো ইমার্জেন্সির মধ্যে কেটে বা ছিলে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, পোকামাকড়ের কামড়, স্ট্রেইন বা মচকে যাওয়া ইত্যাদি অন্যতম। এ ছাড়া সাধারণ রোগের মধ্যে জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, অ্যালার্জি ইত্যাদিা প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা যায় বাড়িতেই।
পরিবারের স্বাস্থ্য পরিকল্পনা
পরিবারের সব সদস্যের কথা বিবেচনা করে স্বাস্থ্য পরিকল্পনা করা উচিত। ছোটখাটো দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সতর্কতার পাশাপাশি ফার্স্ব এইড কিট বা প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নম্বর, জরুরি অ্যাম্বুলেন্স নম্বর, পারিবারিক চিকিৎসকের ফোন ও সেলফোন নম্বর রাখা দরকার। এছাড়াও পরিবারের মাসিক বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে কিছু বরাদ্দ থাকা উচিত। এগুলি বিপদকালে অনেক কাজে লাগে।
সবচেয়ে আগে ফার্স্ব এইড বক্স
ঘরের জন্য বা বাইরে বেড়াতে যাওয়ার সময় প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম বা ফার্স্ব এইড কিট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এটি বাজারে কিনতেও পাওয়া যায়। আপনি নিজেও তৈরি করতে পারেন। ভালোভাবে ঢেকে রাখা যায় এমন কোনো প্লাস্টিক কনটেইনার ব্যবহার করা যেতে পারে এই কাজে। আইসক্রিমের পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বক্স এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে। সুবিধামতো অন্য যে কোনো বক্সও ব্যবহার করতে পারেন।
ফার্স্ব এইড বক্সে যা থাকবে
ড্রেসিং এবং ব্যান্ডেজ
* ২০-২৫টি অ্যাডহেসিভ ব্যান্ডেজ (বিভিন্ন সাইজের), যা ব্যান্ড এইড নামে পরিচিত।
* পাঁচটি স্টেরাইল (জীবাণুমুক্ত) গজ প্যাড (র্৩র্ র্৩র্ সাইজের) এবং (র্৪র্ ৩র্ র্র্ সাইজের)
* গজ রোল তুলা
* মাইক্রোপোর, রোল লিউকোপ্লাস্ট (ব্যান্ডেজ আঠা লাগানোর জন্য)
* ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ (স্ক্রেপ ব্যান্ডেজ)_হাঁটু, কনুই বা গোড়ালির আঘাতের ক্ষেত্রে পেঁচিয়ে এই ব্যান্ডেজ দিতে হয়।
* দুটি ত্রিকোণাকৃতি ব্যান্ডেজ_আর্ম সিলিং তৈরির জন্য।
আরো যা থাকবে
* ২ জোড়া গ্লাভস
* ৫টি সেফটিপিন
* ছোট কাঁচি
* টুইজার বা চিমটা
* একটি থার্মোমিটার
* পকেট মাস্ক (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়ার জন্য)
যে সব ওষুধ রাখতে হবে
* এন্টিসেপটিক সল্যুশন (যেমন বিটাডিন/স্যাভলন/ডেটল ইত্যাদি)।
* এন্টিবায়োটিক ওয়েস্টম্যান (যেমন ব্যাকট্রোবেন)।
* নরমাল স্যালাইন (ছোট বোতল)।
* সিলভার সালফা ডায়াজিন (সিল্ক ক্রিম), পোড়া বা ক্ষতের জন্য।
* হাইড্রোকর্টিসন ক্রিম_পোকায় কামড়ের চিকিৎসায় কাজে লাগে।
* জ্বর ও মাথাব্যথার জন্য_প্যারাসিটামল সিরাপ, ট্যাবলেট ও সাপোজিটরি।
* এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ_ঠাণ্ডা, অ্যালার্জির জন্য
(যেমন অ্যালাট্রল/এভিল/লরাটিডিন)।
* বমিবমি ভাব বা বমি রোধের জন্য_ডমপেরিডন ট্যাবলেট,সাপোজিটরি, সিরাপ।
* ডায়রিয়ার জন্য মুখে খাবার স্যালাইন।
* এসিডিটি রোধের জন্য এন্টাসিড ট্যাবলেট, সিরাপ।
* এ ছাড়াও পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনভিত্তিক কিছু ওষুধ যোগ করা যেতে পারে। যেমন তীব্র ব্যথানাশক হিসাবে আইবুপ্রোফেন রাখা যেতে পারে।
ফার্স্ব এইড কিট যেভাবে রাখতে হবে
সাধারণত শিশুদের নাগালের বাইরে কোথাও রাখা উচিত। তবে এমন জায়গায় রাখতে হবে যেন সহজেই চোখে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে কিচেন কেবিনেটের একটি শুকনো পরিষ্কার স্থান হতে পারে আদর্শ। কেননা রান্নাঘরই অনেক ক্ষেত্রে গার্হস্থ্য দুর্ঘটনার উৎস। বছরে অন্তত দুবার মেয়াদ পরীক্ষা করে ওষুধ বদলানো দরকার। ব্যবহৃত জিনিসগুলো ফেলে নতুন করে কিনে বক্সে রাখা উচিত। পরিবারের অন্য সদস্যদের এর ব্যবহারবিধি শেখনো উচিত।
জরুরি নম্বর ও ঠিকানা সংরক্ষণ
কোনো মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি হলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি না করে যথাস্থানে সাহায্য চাওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক চিকিৎসক, নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও অ্যাম্বুলেন্স নম্বর একটি কাগজে লিখে রাখুন এবং তা সংরক্ষণ করুন ফার্স্ব এইড বক্সের ভেতরে বা চোখে পড়ে এমন জায়গায়। কোন হাসপাতাল কোন বিষয়ের জন্য প্রয়োজনে তাও ছোট করে লিখে রাখুন। যেমন হার্টের সমস্যার জন্য জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। হাত পা ভেঙে গেলে এখানে গিয়ে আপনার লাভ হবে না।
ছোটখাটো দুর্ঘটনায় কী করবেন
যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনায় আতঙ্কিত না হয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করুন এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন। সাধারণত বেশি ঘটে এমন কিছু ছোটখাটো মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি বিষয়ে নিচের টিপসগুলো কাজে লাগবে।
কেটে বা ছিলে গেলে
ঘরের কাজ করার সময় সবচেয়ে বেশি ঘটে এ বিপদটি। এ ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা বা রক্তপাত কমানোই প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া দরকার। পরিষ্কার গজ বা ব্যান্ডেজ দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরুন। হাতে কেটে গেলে হাত কিছুক্ষণ উঁচু করে ধরুন। এতে রক্তক্ষরণ কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে আসবে। অতঃপর বিটাডিন বা এন্টিসেপটিক দিয়ে ওই স্থান পরিষ্কার করে এন্টিবায়োটিক ক্রিম লাগিয়ে ড্রেসিং করুন। রক্ত বন্ধ না হলে বা সেলাই প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। ড্রেসিং এ কাজ হলে একদিন পরপর ওষুধ নতুন করে লাগান।
পুড়ে গেলে
আগুনে বা গরম পানিতে পুড়ে গেলে দ্রুত আক্রান্ত স্থানটি পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানির নিচে ধরুন। আক্রান্ত স্থানে সিল্কক্রিম লাগালে উপকার পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক ক্রিম লাগানো যেতে পারে। পোড়ার পরিমাণ বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ভাঙলে বা মচকালে
আঘাতের স্থান ও পরিমাণ নিরূপণ করুন। হাতে বা পায়ে ফুলে গেলে সেখানে বরফ সেঁক দিন। ডাইক্লোফেনাক জেল হালকা করে লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে কোথাও কেটে গেলে ওই ক্ষতের ওপর সরাসরি এ রকম ক্রিম লাগাবেন না। আক্রান্ত স্থান ম্যাসাজ করবেন না। আক্রান্ত স্থান বিশ্রামে রাখুন। ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়িয়ে রাখুন। তবে অতিরিক্ত ফুলে গেলে বা চামড়ার নিচে কালো হয়ে গেলে হাড়টি ভেঙেছে ধরে নেয়া যায়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে এক্স-রে করে নিশ্চিত হোন ও যথাযথ চিকিৎসা নিন।
মাথায় আঘাত পেলে
আঘাত যদি মাথায় হয় তাহলে সতর্ক থাকা উচিত। আঘাতের পর বমি, অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব, প্রচণ্ড মাথাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ থাকলে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।
বাড়িতে রাখা একটি ফার্স্ব এইড বক্স এবং বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান আপনাকে সাহায্য করবে ছোটখাটো মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি সামলানোর জন্য। এতে জীবন হবে অনেক নিরাপদ।