প্রচ্ছদ > ভ্রমণ > বিদেশ > শান্তির দেশ ভুটান
শান্তির দেশ ভুটান

শান্তির দেশ ভুটান

সুউচ্চ পাহাড়গুলোর কোনোটার মাথা বরফে ঢেকে আছে, আবার কোনোটার মাথার বরফ গলে বেরিয়ে এসেছে চকচকে পাথর। তাতে রোদ পড়ে চকচক করছে। এমন এক দেশ থেকে ঘুরে এসে লিখেছেন অমিতোষ পাল

কল্পনা করুন তো, দু’পাশে আঁকাবাঁকা পাহাড়। সবগুলোরই উচ্চতা মেঘের স্তর ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। মাঝ দিয়ে বিমান সমতলভাবে চলতে গেলে পাহাড়ে ডানা বেঁধে যাওয়ার ঝুঁকি। কিন্তু যেখানে যেমনভাবে কাঁত করা প্রয়োজন, সেটা করে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বিমানটাকে এগিয়ে নিলেন পাইলট। সরু রানওয়ের কাছে গিয়েই বিমানটা সোজা হয়ে রানওয়ে স্পর্শ করল। তারপর বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই নামল। দৃশ্যটা শান্তির দেশ ভুটানের পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। ভাবতে পারেন, এত ঝুঁকির মধ্যে যাওয়ার কি দরকার। ব্যাপার হলো, ঝুঁকির সঙ্গে রোমাঞ্চও যে আছে। আর এতদিনে একটি দুর্ঘটনাও যে ঘটেনি, সেটাও তো জানা দরকার। বরং ভ্রমণের এ এক নতুন মজা। রোমাঞ্চের দিক থেকে পারো এয়ারপোর্ট বিশ্বের সাত নম্বরে। এ তালিকায় হলান্ডের জুলিয়ানা বা ব্রাজিলের কংগোনাস এয়ারপোর্টের তুলনা করলে সেখানে রোমাঞ্চের চেয়ে ঝুঁকিই বেশি। সেদিক থেকে পারো এয়ারপোর্টে কেবলই রোমাঞ্চকর ও মজার। চারদিনের জন্য ভুটানে গিয়েছিলাম। সঙ্গে দৈনিক কালের কণ্ঠের আইটি ম্যানেজার বন্ধু অর্ণব। আর বিমানে পেয়ে গেলাম হানিমুন করতে যাওয়া নবদম্পতি রুমন-মিমিকে। বিমান থেকেই ভুটানের যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তাতে মনে হলো খরচ বৃথা যাবে না। সুউচ্চ পাহাড়গুলোর কোনোটার মাথা বরফে ঢেকে আছে, আবার কোনোটার মাথার বরফ গলে বেরিয়ে এসেছে চকচকে পাথর। তাতে রোদ পড়ে চকচক করছে। বরফেরটা সোনালি, পাথরেরটা রূপালি। বিমান থেকে বেরুতেই ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া শরীরে এসে বিঁধল। এরপর সহজেই বিনা খরচায় মিলে গেল অন অ্যারাইভাল ভিসা। তারপর চারটা দিন সৌন্দর্যের মধ্যেই কেটে গেল। উন্নত দেশগুলো অনেক অর্থের শ্রাদ্ধ করে তাদের দেশটাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সেসব দেশের সঙ্গে পার্থক্য, প্রাকৃতিকভাবেই ভুটান সুন্দর। শহরটা আরও সুন্দর। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত সবকিছু। সবগুলো রাস্তা তৈরি হয়েছে পাহাড় কেটে। সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে ছিমছাম রাস্তাগুলো। দু’পাশে আপেল, কমলা বা আঙুর গাছের ছড়াছড়ি। প্রথম দিনে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে গেলাম হোটেলে। থিম্পুর প্রাণকেন্দ্র ক্লক টাওয়ারের সামনেই হোটেল ডেসটিনি। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে মধ্যাহ্নভোজ শেষে মাইক্রোবাসে বেরিয়ে পড়লাম সাইট সিইংয়ের জন্য। প্রথমেই ন্যাশনাল মেমোরিয়াল সোরটিন। চারপাশে বিশাল প্রাচীর বেষ্টিত সুউচ্চ গম্বুজওয়ালা বৌদ্ধমন্দির। সেটা বারবার প্রদক্ষিণ করছেন নানা দেশের পর্যটক। মিথ আছে, এক, তিন, ১০৮ বা এক হাজার বার ঘুরে বুদ্ধের কাছে মন থেকে কিছু চাইলে আশা পূরণ হয়। থিম্পুতেই আছে টাকিন ন্যাশনাল রিজার্ভ ফরেস্ট। চিড়িয়াখানার আঙ্গিকে পাহাড়ি বনানীর মধ্যে সংরক্ষিত এই বনের মূল আকর্ষণ টাকিন প্রাণী। মুখটা অবিকল ছাগলের, দেহটা গরুর। মিথ আছে, বৌদ্ধভিক্ষু সাবডুং নাওয়া নামগো গরুর মাথা কেটে ছাগলের মাথা সংযোজন করে দিয়েছিলেন। পাইন গাছের বনের মধ্যে দিবি্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে টাকিনগুলো। পার্লামেন্ট ভবন ও রাজার বাসভবন কিংস প্যালেসে রয়েছে স্বতন্ত্র নির্মাণশৈলী। ওপরে মিনার সংবলিত বিশাল চৌচালা ভবন। যে কেউ দেখলেই আকৃষ্ট হবেন। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে থিম্পু চু নদী। হিমালয়ের বরফগলা খরস্রোতা নদীটি শহরের মাঝ দিয়ে সর্পিলভাবে বয়ে গেছে। স্বচ্ছ পানির মধ্য দিয়েও তলদেশের পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। থিম্পু শহরের মধ্যেই তৈরি হচ্ছে বুদ্ধ পয়েন্ট। ২ হাজার ফুট উঁচু পাহাড় কেটে সমতল করে তৈরি হচ্ছে বুদ্ধ পয়েন্ট। ওপরে ২০০ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি। চারপাশের পাহাড়গুলোর সৌন্দর্য এখান থেকে উপভোগ করার মতো। থিম্পু শহরও এখান থেকে একনজরে চোখে পড়ে। থিম্পু শহর থেকে ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে দোচালা পাস পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ১৪ বছর আগে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফা গোষ্ঠীর সঙ্গে ভুটানিদের সেখানে যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে তৈরি হয়েছে দোচালা। পাহাড়ের ওপরে এটাও কারুকার্যখচিত বৌদ্ধমন্দির। পাশের পাহাড়ে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে সুতায় ছোট ছোট চৌকোনা করে কাটা কাপড়গুলো বেঁধে গাছ থেকে গাছে টানিয়ে দেওয়া। দোচালা পাস থেকে সহজেই বরফে ঢাকা হিমালয় চোখে পড়ে। সূর্যের আলো পড়লে হিমালয়ের সোনালি রঙ ধারণ করে। সেই জ্যোতি দোচালাতেও ঝিলিক দেয়। পাহাড়ি পথে যেতে যেতে কেবলই চোখে পড়ে রাস্তার পাশে ভুটানি নারীদের ফলের পসরা সাজিয়ে রাখার দৃশ্য। ভুটানের আরেকটি জায়গা চেলালা। পারো থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। পেঁৗছানোর আট-দশ কিমি. আগেই বরফ দেখা যায়। এক সময় গাছপালা ছাড়া সবই দেখা যায় ঢেকে আছে বরফে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বরফের দেখা মেলে। এপ্রিল-মে মাসে রাস্তার দু’ধারে ফুটে ওঠে ১৪৮ রঙের রডোরেনড্রন ফুল। সেই দৃশ্যও মুগ্ধ করবে বলে জানাল গাইড গুরু গুরুং। পারোর আরেকটি আকর্ষণ প্রাচীন ডংচে মনেস্ট্রি। কমলা গাছে ঘেরা এই মন্দিরের মিনারের গম্বুজটি ষোল শতক থেকে শিকল দিয়ে বাঁধা। মিথ আছে, শিকল খুলে দিলেই গম্বুজ ও মিনার উড়ে আকাশে চলে যাবে। আরও আছে পারো মিউজিয়াম, পারো জং, টাইগার নেস্ট, হোম মিউজিয়াম, ড্রুক গেইল জংসহ কত কী।

 

ভুটান সম্পর্কে

৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের পুরো দেশটাই পাহাড়ে ভরা। একটি জুৎসই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার মতো সমতল জায়গা ভুটানে নেই। মাথাপিছু গড় আয় ১ হাজার ৫০ মার্কিন ডলার। দেশে বড় কোনো শিল্পকারখানা নেই। লোকসংখ্যা ৭ লাখ। আয়ের মূল উৎস বিদ্যুৎ, ফল ও পর্যটন। জীবনযাত্রার ব্যয় খুবই কম। পানীয় মেলে স্বল্পমূল্যে। তামাক জাতীয় দ্রব্য ভুটানে নিষিদ্ধ, পর্যটক ছাড়া। অবশ্য ট্যাক্স দিতে হয় ২০০ শতাংশ। বাংলাদেশি খাবারও মিলবে।

 

যেভাবে যাবেন

সড়কপথে ভারত থেকে ফুন্টসলিং সীমান্ত হয়ে ভুটান যেতে পারেন। ফুন্টসলিং থেকে দিনের বেলা বাস যায়। সময় লাগবে ছয়-সাত ঘণ্টা। আর বিমানে যেতে হলে রয়েছে ভুটানের সরকারি বিমান সংস্থা ড্রুক এয়ার। আকাশপথে ভুটান যাওয়ার এটাই একমাত্র এয়ারলাইন্স। রিটার্ন টিকিটের মূল্য ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। বাংলামোটরের ১২ নম্বর সোনারগাঁ রোডের সোনারতরী টাওয়ারে ড্রুক এয়ারের প্রধান কার্যালয়। সরাসরি টিকিট কিনলে দাম সবচেয়ে কম পড়বে। ড্রুক কর্তৃপক্ষ প্যাকেজের আয়োজনও করে থাকে। তাতে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া, সাইট সিইংসহ সবকিছু পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মধ্যেই আরামে বেড়িয়ে আসতে পারবেন। মার্চ থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস ভুটান ভ্রমণের সবচেয়ে উত্তম সময়।

Comments

comments

Comments are closed.