প্রচ্ছদ > জেনে নিন > এসএসসির পর কারিগরি শিক্ষা
এসএসসির পর কারিগরি শিক্ষা

এসএসসির পর কারিগরি শিক্ষা

এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো গত ৩১ মে। এটা যেমন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, তেমনি চলার পথে একটা বড় বাঁকও হতে পারে। কারণ দেখা যায় এ স্তর থেকেই কর্মসংস্থানের বাস্তব প্রেক্ষাপট ও পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে অনেকে তার গন্তব্য বা যাত্রাপথ বদলে ফেলে।

এ বছরের প্রেক্ষাপট অন্যান্য বছরের চেয়ে আলাদা। আগামীর পৃথিবী হবে প্রযুক্তিনির্ভর ও পরিবর্তনমুখী। তবে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের প্রভাবে এই পরিবর্তন যে এত দ্রুত হবে, তা একেবারেই অনুমেয় ছিল না। যারা এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো, তারা এত দিন যে পৃথিবী বা প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে পেশাজীবনের পরিকল্পনা করেছে, মাত্র দু-তিন মাসের ব্যবধানে সেটা আমূল বদলে গেছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে। আর এই পরিকল্পনায় গুরুত্ব দিতে হবে কারিগরি দক্ষতাকে।

এ বছর যারা এসএসসি উত্তীর্ণ হলে, দ্রুতই পেশাজীবনে প্রবেশ করতে চাইলে তারা সামনে পা বাড়ানোর আগে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে পারো। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৪৫০টির বেশি পলিটেকনিক রয়েছে, যেখানে এসএসসি পাসের পর ভর্তি হয়ে ৪ বছরের মধ্যে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হিসেবে সরকারি বা বেসরকারি, দেশে বা বিদেশের প্রতিষ্ঠানে নিজের স্থান করে নেওয়া সম্ভব। পুরকৌশল, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল, যন্ত্রকৌশল, অটোমোবাইল, ফুড, এনভায়রনমেন্টাল, কেমিক্যাল, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, স্থাপত্য, টেলিযোগাযোগ—প্রতিষ্ঠানভেদে এমন নানা বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হয়ে পরবর্তী সময়ে চাইলে স্নাতক ডিগ্রিও অর্জন করা যায়।

সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে এসএসসি পাস করে একজন শিক্ষার্থী দুই বছরের এইচএসসি ও চার বছরের অনার্স কোর্স পাস করে মোট ছয় বছর পড়া শেষ করে চাকরির বাজারে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নেন। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে এসএসসি পাসকৃত একজন শিক্ষার্থী সরাসরি চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা গ্রহণ করে সাধারণ শিক্ষার্থীর তুলনায় দুই বছর আগেই উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারেন। কারিগরি কোর্সের শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে প্রশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্টের মাধ্যমে সরাসরি বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। তারা চাকরির পাশাপাশি সান্ধ্যকালীন ব্যাচে বিএসসি ডিগ্রি নিতে পারেন। তুলনামূলক কম সময়ে কোর্স সমাপ্তি আর কোর্স শেষে নূ্যনতম চাকরির নিশ্চয়তা- এ দুইয়ে মিলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলের চাহিদা হালের শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে বেশি। চার বছর মেয়াদি এই কোর্সে ভর্তি হতে হয় এসএসসির পর। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে বিভিন্ন জেলা শহরে অবস্থিত সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাড়াও ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক, গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সার্ভে ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়।

ভর্তির যোগ্যতা: চার বছর মেয়াদি এই কোর্সগুলোয় আবেদন করতে হলে সাধারণ গণিত অথবা উচ্চতর গণিতে কমপক্ষে জিপিএ ৩সহ প্রার্থীকে অবশ্যই এসএসসি পাস হতে হবে ন্যূনতম জিপিএ ৩.৫ পেয়ে।

বিষয় : আর্কিটেকচার, অটোমোবাইল, কেমিক্যাল, সিভিল, সিভিল (উড), কম্পিউটার, ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিকস, ফুড, পাওয়ার, মেকানিক্যাল, প্রিন্টিং, গ্রাফিক ডিজাইন, গ্গ্নাস, সিরামিক, ইলেকট্রো মেডিকেল, মেরিন, শিপবিল্ডিং, সার্ভেয়িং, মেকাটনিকস, কনস্ট্রাকশন, টেলিকমিউনিকেশন, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইন, গার্মেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড প্যাটার্ন মেকিং, ইন্সট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড প্রসেস কন্ট্রোল, ডাটা টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং, এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং (অ্যারোস্পেস), এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং (অ্যাভিয়োনিকস) এবং মাইনিং অ্যান্ড মাইন সার্ভে টেকনোলজি পড়ানো হয় সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা এই ইনস্টিটিউটগুলোয়।

ভর্তির তথ্য : এসএসসির পর ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হতে চাইলে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। ভর্তিসংক্রান্ত সব তথ্যের জন্য যোগাযোগ করা যাবে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের www.techedu.gov.bd) ওয়েবসাইটে। এ ছাড়া ভর্তিসংক্রান্ত সব তথ্য জানা যাবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নিজস্ব ওয়েবসাইটে (www.bteb.gov.bd)

এভিয়েশন বিষয়ে পড়াশোনা : এসএসসি ও লেভেল পাস করেই বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা দেশেই শুরু করতে পারেন উড়োজাহাজ প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা। এ বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে নিজেকে গড়ে তোলা যায় একজন বিমান প্রকৌশলী হিসেবে। ও-লেভেল বা এসএসসির পর খুব সহজেই উড়োজাহাজ প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করে এ বিষয়ে প্রকৌশলী হওয়া যায়। পাস করার পর দেশের এয়ারলাইন্সগুলোতে রয়েছে কাজ করার অফুরন্ত সুযোগ। তা ছাড়া বিশ্বজুড়ে ৫ হাজার ৫১০টিরও অধিক এয়ারলাইন্স কোম্পানিতে রয়েছে উড়োজাহাজ প্রকৌশলীদের জন্য কাজ করার লোভনীয় সব অফার।

ডিপ্লোমা প্রকৌশলের আরও কিছু বিষয় :
বস্ত্র প্রকৌশল : ডিপ্লোমা প্রকৌশলের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ের চাহিদা বেশি, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বা বস্ত্র প্রকৌশল। সরকারের বস্ত্র দপ্তরের (www.dot.gov.bd) আওতায় দিনাজপুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, বরিশাল শহীদ সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও টাঙ্গাইল টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট- এই তিনটি সরকারি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট আছে। এ ছাড়া বেসরকারি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট আছে ২১টি। ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে হবে অনলাইনের মাধ্যমে। ইনস্টিটিউটগুলো থেকে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া যাবে বাংলাদেশ টেক্সটাইল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কৃষি প্রকৌশল : কৃষি ক্ষেত্রকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোয় চালু আছে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স। কারিগরি শিক্ষা বোডের্র অধীনে রংপুর, গাইবান্ধা, পাবনা, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা, গাজীপুর, শেরপুর, সিলেট, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি জেলায় একটি করে মোট ১৩টি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আছে। এই ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করতে হলে প্রার্থীকে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৩ অথবা বিজ্ঞান বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগের ক্ষেত্রে সাধারণ গণিত বা সাধারণ বিজ্ঞানে গ্রেড পয়েন্ট ২সহ কমপক্ষে জিপিএ ৩ থাকতে হবে।

হেলথ টেকনোলজি অ্যান্ড সার্ভিসেস : তিন বছর মেয়াদি এই কোর্স বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধিভুক্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৯। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, সেগুলো হলো- ডেন্টাল, পেশেন্ট কেয়ার, ফিজিওথেরাপি, ফার্মা, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং।

সবাই হয়তো কারিগরি শিক্ষায় পড়াশোনা করবে না বা সুযোগ পাবে না। কিংবা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ শিক্ষাক্ষেত্রেই পড়বে। তবে যারা সাধারণ শিক্ষায় ভবিষ্যৎ শিক্ষা পরিকল্পনা করছে, তাদেরও নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি কারিগরি জ্ঞান অর্জন করতে হবে সামনের পৃথিবীতে নিজের অবস্থান টেকসই করার জন্য।

পলিটেকনিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম একটি দিক হচ্ছে, এখানে সেশনজট নেই এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শিক্ষাক্রম সম্পন্ন হয়। যেহেতু পলিটেকনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাক্রম, তাই একজন শিক্ষার্থীর প্রযুক্তি জ্ঞান বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবকের পলিটেকনিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই। সামনের দিনগুলোতে আমাদের প্রযু্ক্তি নির্ভরতা বাড়বে আরও। তাই প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কারিগরি জ্ঞান শিক্ষার্থীদের এগিয়ে রাখবে।

শুধু সচেতনতার অভাবে আমরা আমাদের আশপাশে থাকা সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে পারি না। পাস করে তারপর চাকরি বা ব্যবসার প্রস্তুতি নেব, এমন সময় সম্ভবত আমদের আর নেই। বিষয়টি আমাদের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের এই মুহূর্ত থেকে অনুধাবন করতে হবে। যার কারিগরি দক্ষতা আছে, তাকে বেকারত্ব স্পর্শ করতে পারে না।

.

Comments

comments

Comments are closed.